খাবার নাকি বিষ খাচ্ছি?

ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি গ্রামের তরতাজা সবজি, নদীর চকচকে মাছ আর বাড়িতে পালা গরুর মাংসের জন্য মানুষের আগ্রহ। সেই মাংসের যে স্বাদ আর ঘ্রাণ ছিল, তা যেন এখনো মুখে লেগে আছে। কিন্তু আজকাল বাজারে হাজার টাকা দিয়ে মাংস কিনেও কেন সেই স্বাদটা পাওয়া যায় না? সবজিগুলো দেখতে সুন্দর হলেও মুখে দিলে কেমন যেন পানসে লাগে?

এর পেছনের কারণটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? কারণটা লুকিয়ে আছে আমাদের কৃষিব্যবস্থায়, আমাদের মাটিতে। আর এর জন্য দায়ী আমাদের ‘দ্রুত ফলন’ আর ‘বেশি লাভের’ মানসিকতা।

বিষাক্ত চক্রটা যেভাবে কাজ করছে:

১. জমির উপর অত্যাচার: আমরা অধিক ফসলের আশায় জমিতে ঢেলে দিচ্ছি প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রাসায়নিক সার (ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ) ও কীটনাশক। এই অতিরিক্ত রাসায়নিক শুষে নেওয়ার ক্ষমতা মাটির নেই। ফলে মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরতা হারাচ্ছে, হয়ে উঠছে বিষাক্ত।

২. ফসল যখন বিষ: গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টির সাথে মাটি থেকে শুষে নিচ্ছে এই অতিরিক্ত রাসায়নিকও। ফলে ধান, গম, ভুট্টা, শাক-সবজি—সবই বিষাক্ত রাসায়নিকের এক নীরব বাহক হয়ে উঠছে। খালি চোখে এই বিষ দেখা যায় না, কিন্তু তা সরাসরি প্রবেশ করছে আমাদের খাদ্য তালিকায়।

৩. গবাদি পশুর মাংসে বিষ: এই চক্রের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এটি শুধু ফসলেই থেমে থাকছে না। আমাদের গৃহপালিত পশু—গরু, ছাগল কী খাচ্ছে? সেই জমিতে জন্মানো ঘাস, ধানের খড়, ভুট্টার গাছ। ফসলের মাধ্যমে যে বিষাক্ত রাসায়নিক গাছে জমা হয়েছিল, তা এখন চলে যাচ্ছে পশুর শরীরে। এই রাসায়নিক পশুর মাংসে, চর্বিতে, এমনকি দুধেও জমা হচ্ছে।

ফলাফল? আমরা যখন সেই গরুর মাংস খাচ্ছি, তখন আসলে শুধু মাংস খাচ্ছি না, সাথে খাচ্ছি জমিতে দেওয়া সেই অতিরিক্ত সারের বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ। একারণেই আজকের মাংসে সেই আগের স্বাভাবিক স্বাদ নেই, আছে এক ধরনের রাসায়নিক আস্তর। শুধু স্বাদই হারাচ্ছে না, এই বিষাক্ত খাবার খেয়ে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসার, কিডনি রোগ, হৃদরোগের মতো মারাত্মক সব ব্যাধি।

আমরা সারের মাধ্যমে যে বিষ চক্রাকারে মাটিতে দিচ্ছি, তা আবার পশু হয়ে আমাদের খাবার টেবিলেই ফিরে আসছে।

এই ভয়ংকর চক্র থেকে মুক্তির উপায় কী?

হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সমাধান আমাদের হাতেই আছে। প্রয়োজন শুধু সম্মিলিত উদ্যোগ আর সচেতনতা।

মাটি পরীক্ষা: না জেনে জমিতে সার দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কৃষি কর্মকর্তার உதவியে মাটি পরীক্ষা করে যতটুকু সার প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই প্রয়োগ করতে হবে।
জৈব সারের ব্যবহার: রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার), গোবর সার, এবং সবুজ সারের মতো জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটি মাটির উর্বরতা স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে আনবে।
সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থাপনা: শুধু রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে পোকা দমনের প্রাকৃতিক পদ্ধতি (যেমন পার্চিং, ফেরোমোন ফাঁদ) ব্যবহার করতে হবে।
কৃষক প্রশিক্ষণ: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষকদের আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অতিরিক্ত সারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে।
ভোক্তা সচেতনতা: ক্রেতা হিসেবে আমাদেরকেও সচেতন হতে হবে। অর্গানিক বা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে এবং নিরাপদ খাদ্যের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে।*
আসুন, শুধু আজকের লাভের কথা না ভেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করি। যে মাটি আমাদের অন্ন দেয়, সে মাটিকে বিষাক্ত করার অধিকার আমাদের নেই।

মাটিকে বাঁচালে, বাঁচব আমরা।

কৃষি #খাদ্যনিরাপত্তা #জৈবচাষ #সচেতনতা #বাংলাদেশ #স্বাস্থ্য #পরিবেশ #SafeFoodSafeLife #organicfarming #Bangladesh