মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুঃস্বপ্ন: বৈধতার সংকটে লাখ লাখ জীবন!


মালয়েশিয়ার প্রবাসজীবনে বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমিকেরা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে যেমন তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, অন্যদিকে তাদের বড় একটি অংশ বৈধতার অভাবে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এই অনিশ্চয়তা শুধু তাদের কাজের সুরক্ষাই কেড়ে নিচ্ছে না, বরং তাদের জীবনের স্বাভাবিক গতিকেও ব্যাহত করছে।
কেন এত সংখ্যক শ্রমিক অবৈধ?
মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ঠিক কত, তা বলা কঠিন। তবে বিভিন্ন সূত্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, এই সংখ্যা কয়েক লাখ হতে পারে। বৈধভাবে প্রবেশ করার পরও অনেক সময় শ্রমিকেরা নানা কারণে অবৈধ হয়ে যান। এর কয়েকটি প্রধান কারণ হলো:

  • ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া: অনেক সময় কাজের চুক্তি শেষ হওয়ার পর নতুন কাজ না পাওয়ায় বা ভিসা নবায়নের প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় তারা অবৈধ হয়ে পড়েন।
  • নিয়োগকর্তার অসহযোগিতা: কিছু অসাধু নিয়োগকর্তা শ্রমিকদের বৈধ কাগজপত্র বা ভিসা নবায়নে সহায়তা করেন না, ফলে শ্রমিকেরা বিপাকে পড়েন।
  • মিথ্যা প্রলোভন: অনেক দালাল বা এজেন্ট ভালো বেতনের চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসেন, কিন্তু সেখানে এসে দেখা যায় তাদের কোনো কাজ নেই। ফলে জীবনধারণের তাগিদে তারা অবৈধভাবে যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হন।
  • উচ্চ অভিবাসন খরচ: মালয়েশিয়ায় আসার জন্য শ্রমিকদের উচ্চ অংকের টাকা খরচ করতে হয়। এই টাকা উঠাতে গিয়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হন এবং বৈধতার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন না।

অবৈধতার পরিণাম:
অবৈধভাবে বসবাসকারী শ্রমিকদের জীবনমান খুবই শোচনীয়। তারা সব সময় গ্রেফতার বা বিতাড়িত হওয়ার ভয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, তারা সাধারণত কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন এবং তাদের কাজের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে বা অসুস্থ হলে তারা চিকিৎসার সুযোগ পান না। তাদের কোনো আইনগত অধিকারও থাকে না। ফলে নিয়োগকর্তা বা অন্য কোনো পক্ষ তাদের সাথে যেকোনো অন্যায় করতে পারে।


সরকারের পদক্ষেপ:

আশার আলো নাকি নতুন সংকট
মালয়েশিয়া সরকার সময়ে সময়ে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘শ্রমিক পুনর্বাসন প্রোগ্রাম’ (Labour Recalibration Programme – RTK)। এই প্রোগ্রামগুলো বহু শ্রমিককে বৈধতা পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তবে অনেক সময় এই প্রক্রিয়ার খরচ বেশি হওয়ায় বা তথ্যগত জটিলতার কারণে সবাই এর সুবিধা নিতে পারেননি।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযান আরও কঠোর করেছে। এর ফলে একদিকে যেমন শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে, অন্যদিকে যারা বৈধ হতে চাইছেন, তাদের জন্য সুযোগগুলো আরও সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
সমাধানের পথ কোথায়?
এই জটিল পরিস্থিতির সমাধানের জন্য উভয় দেশের সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করা এবং দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা। মালয়েশিয়া সরকারেরও উচিত, বৈধকরণ প্রক্রিয়া আরও সহজ ও সাশ্রয়ী করা, যাতে শ্রমিকেরা সহজেই বৈধতা পেতে পারেন।
তবে সবচেয়ে জরুরি হলো, শ্রমিকদের সচেতনতা বাড়ানো। মালয়েশিয়ায় আসার আগে কাজের চুক্তি, বেতন, এবং ভিসার বৈধতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে তারা সম্ভাব্য বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন।
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। তাদের জীবন ও অধিকার সুরক্ষিত করা তাই শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য। এই বিষয়ে দুই দেশের সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।